ঢাকা, ৩১ জানুয়ারি- কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও উৎপাদনমুখী খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে চলতি অর্থবছরের (২০১৮-১৯) দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি (জানুয়ারি-জুন, ২০১৯) ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন এ মুদ্রানীতিকে গতানুগতিক বললেও তা বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা। বুধবার এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। চলতি অর্থবছরের জুলাই-জুন সময়ে মুদ্রা ও অর্থনীতি কার্যক্রমের সামগ্রিক সফলতার প্রেক্ষাপটে নতুন মুদ্রানীতিতে বড় কোনো পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হয়নি বলে জানান গভর্নর। নতুন মুদ্রানীতিতে রেপো ও রিভার্স রেপো সুদহার ৬ শতাংশ এবং ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৫ দশমিক ৯ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। তবে অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতির গতিধারা বিবেচনায় নিয়ে নতুন মুদ্রানীতিতে জুন শেষে সরকারি-বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি আগের ৮ দশমিক ৫ এবং ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে সংশোধন করে যথাক্রমে ১০ দশমিক ৯ ও ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছে বলে জানান ফজলে কবির। মুদ্রানীতিতে যেসব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা মোটামুটি ঠিক থাকলেও এটি বাস্তবায়নই মূল চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, মুদ্রানীতিতে দু-একটি বিষয়ে কিছু লক্ষ্যমাত্রায় পরিবর্তন আনা হলেও তেমন নতুন কিছু নেই। বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এটি বেশি কমানো হয়নি উল্লেখ করে প্রবীণ এ অর্থনীতিবিদ বলেন, গত ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ। আগামী ছয় মাসে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। কারণ, বর্তমানে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে উদ্যোক্তাদের আগ্রহ কম। এর মূল কারণ, বিনিয়োগের যথাযথ পরিবেশ নেই। শুধু টাকা থাকলেই মানুষ বিনিযোগ করে না। বিনিয়োগের জন্য সুস্থ পরিবেশ দরকার। অর্থাৎ অবকাঠামো সুবিধা, সুশাসন নিশ্চিত করা, ইজ অব ডুয়িং বিজনেস বা ব্যবসা সহজীকরণ করা। দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসাবান্ধব নীতি গ্রহণ করা, যার বেশির ভাগই ঘাটতি রয়েছে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু মুদ্রানীতিতে লক্ষ্যমাত্রা ধরলেই ঋণপ্রবাহ বাড়বে না। ঋণপ্রবাহ বাড়াতে হলে বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংক খাত থেকে সরকারি ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে- এটি তেমন প্রভাব ফেলবে না উল্লেখ করে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সঞ্চয়পত্রই সরকারের চাহিদার বেশির ভাগ অর্থ জোগান দিচ্ছে। বর্তমানে সুদ বেশি পাওয়ায় সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকছেন বিনিয়োগকারীরা। এটি অব্যাহত থাকলে ব্যাংক থেকে তেমন ঋণ নেবে না সরকার- মনে করেন তিনি। দেশের সার্বিক কর্মসংস্থান ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর ক্ষেত্রে মুদ্রানীতি তেমন কোনো ভূমিকা রাখে না, এ মুদ্রানীতিও রাখবে না বলে জানান প্রবীণ এ অর্থনীতিবিদ। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ব্যাংক থেকে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ সুদে কে ঋণ নেয়? দেশে কি এমন ব্যবসা আছে যে, এত লাভ হবে? ঋণ কি শুধু নিলেই হবে, পরিশোধ করতে হবে না? এজন্য বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমানোর টার্গেট ঠিকই আছে। তিনি বলেন, সরকার প্রবৃদ্ধির হার ৭.৮ শতাংশ থেকে ডাবল ডিজিটে নিতে চায়। এটি করতে হলে বেসরকারি খাতের সহযোগিতা ছাড়া হবে না। কারণ, দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বেসরকারি খাত। এ খাতকে শক্তিশালী করতে হলে অবশ্যই ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানো, ব্যবসা সহজীকরণসহ অবকাঠামো দুর্বলতা দূর করতে হবে। বিনিয়োগ কোনো একক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে না, সামগ্রিক বিষয়ে উন্নতি করতে পারলেই বিনিয়োগ বাড়বে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ কমানোর বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যবসা মানেই ঝুঁকি। এখন দেখতে হবে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে প্রকৃতভাবে কে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আর কে ঋণ নিয়ে পালিয়ে গেছে, বিদেশে টাকা পাচার করেছে? আমার স্পষ্ট কথা, যারা ব্যবসা করে লস করেছে, তাদের আবার পুনরুজ্জীবিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা ঋণের নামে লুটপাট করেছে, দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে টাকা নিয়ে গেছে, তাদের শুধু গ্রেফতার করলেই হবে না, প্রয়োজনে আইন পরিবর্তন করে তাদের দ্রুত সময়ে মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এদিকে, মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে ব্যাংকের আমানত ও ঋণে ৬ ও ৯ শতাংশ সুদহার প্রসঙ্গে গভর্নরকে প্রশ্ন করা হলে তার উত্তরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং রিফর্ম অ্যাডভাইজার এস কে সুর চৌধুরী বলেন, ৬ ও ৯ সুদহার বাস্তবায়ন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিষয় নয়। এটি ব্যাংকগুলোর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে। গত বছর যখন ৬ ও ৯ সুদহারের প্রসঙ্গ আসে তখন ঋণের সুদ ছিল ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ। এখন তা ১০ থেকে ১২ শতাংশে নেমে এসেছে বলে জানান তিনি। নতুন মুদ্রানীতি প্রসঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, বর্তমান যে তারল্য এ খাতে আছে, তা দিয়ে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা চ্যালেঞ্জিং হবে। এখন ডলার কিনতে গিয়ে প্রচুর টাকা চলে যাচ্ছে। এর মধ্যে সরকারি খাতের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে, এতে ব্যাংকগুলো আরও চাপে পড়বে। তিনি বলেন, আগামী মার্চের মধ্যে অনেক ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের রেশিও (এডিআর) কমাতে হবে। এটি কমাতে গেলে ব্যাংকগুলোর ওপরই চাপ পড়বে। কারণ, তাদের সমন্বয় করতে হলে এক জায়গা থেকে টাকা অন্য জায়গায় জোগান দিতে হবে। নতুন মুদ্রানীতিতে মন্দ ঋণ বা নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) কমাতে বলা হয়েছে, আমানত বাড়াতে বলা হয়েছে- এটি ভালো, তবে তা বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন ব্যাংকারদের এ নেতা। এদিকে, মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে গভর্নর ফজলে কবির বলেন, দেশে বর্তমানে ৫৯টি ব্যাংকের মধ্যে ১১টির এডিআর রেশিও বেশি রয়েছে। আগামী মার্চের মধ্যে এটি সমন্বয় করতে হবে। এটি করতে গিয়ে ব্যাংক খাতে কোনো সমস্যা হবে না। কারণ, বর্তমানে এ খাতে ৭৯ হাজার ৩৪২ কোটি টাকার মতো তারল্য আছে। গভর্নর বলেন, অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু ডিসেম্বর শেষে দেখা যায়, এ খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যের চেয়ে অনেক কম হয়েছে; ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ। সদ্য সমাপ্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সম্ভাব্য অনিশ্চয়তা-উৎকণ্ঠা এর একটি কারণ হয়ে থাকতে পারে বলে জানান তিনি। অন্যদিকে, সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৬ শতাংশ লক্ষ্যের চেয়ে ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। আর গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে আটকে রাখার আশা করা হয়েছে। এদিকে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ আর গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে আটকে রাখার আশা করা হয়েছিল। কিন্তু অর্থবছর শেষে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশে পৌঁছে। আর পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ। গড় মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি বছর দুবার মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও প্রকাশ করে। ছয় মাস অন্তর এ মুদ্রানীতি একটি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই মাসে এবং অন্যটি জানুয়ারি মাসে প্রণয়ন হয়। দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় মুদ্রানীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে পরবর্তী ছয় মাসে অভ্যন্তরীণ ঋণ, মুদ্রার সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ, বৈদেশিক সম্পদ কতটুকু বাড়বে বা কমবে এর একটি পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। আর/০৮:১৪/৩১ জানুয়ারি

from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://bit.ly/2RrPCzR