ঢাকা, ১৪ ফেব্রুয়ারি- রাজনৈতিক দলগুলো নয়, সুশীল সমাজের সঙ্গে সমঝোতার পরিকল্পনা নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সুশীল সমাজের একটি বড় অংশ আওয়ামী বিরোধী অবস্থান নিয়েছে এবং বিভিন্নভাবে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করছে। এদের অনেকেই একসময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিল। কিন্তু নানা কারণে তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ এই সুশীলদের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে ফেলতে চায়। আওয়ামী লীগ মনে করছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয় বরং সুশীলদের সঙ্গে সুসম্পর্কের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ একটি স্বচ্ছ ও ভালো ভাবমূর্তি তৈরী করতে পারবে। আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকদের একাধিক সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে একটি মত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়, সুশীল সমাজের সঙ্গে সমঝোতা দরকার। এর পিছনে ত্রিমাত্রিক কারণ রয়েছে। প্রথমত; সুশীল সমাজই সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন নেতিবাচক কথাবার্তা প্রচার করছে। দ্বিতীয়ত; এরা আওয়ামী লীগের সঙ্গেই সম্পর্কিত ছিল এবং এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে। কাজেই তাদের সঙ্গে দূরত্ব রাখা ঠিক না। তৃতীয়ত; আওয়ামী লীগ উন্নত একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে। যে মুহূর্তে দেশ উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সেই উন্নতির জন্য সবাইকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করতে হবে। সেখানে সুশীলরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রধানমন্তী শেখ হাসিনা জার্মানির উদ্দেশে দেশ ছাড়ার আগে দলের নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় সুশীলদের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে ফেলার পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টামণ্ডলীর মধ্য থেকে তিনজনকে সুশীলদের সঙ্গে নতুন করে যোগযোগ স্থাপন এবং তাদের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে ফেলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যাদেরকে দেয়া হয়েছে তারা হলেন- প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। জানা গেছে যে, যে সকল সুশীল এখন আওয়ামী লীগের সমালোচনায় সোচ্চার, এদের অনেকেই একসময় আওয়ামী আওয়ামী ভাবাপন্ন ছিলেন। নানা কারণে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে এবং তারা আওয়ামী লীগের কঠোর সমালোচক হয়েছেন। যাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করছে তাদের মধ্যে রয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আওয়ামী লীগের প্রথম ১৯৯৬-২০০১ শাসনামলে ড. ইউনূসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সুসম্পর্ক ছিল। তারপর নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। মার্কিন দূতাবাস, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে ড. ইউনূস নিজেই সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে গড়তে চান। এ ব্যাপারে আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে। উভয়পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ড. ইউনূসের একটি সাক্ষাৎ হতে পারে। আওয়ামী লীগ মনে করছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আওয়ামী লীগের ইমেজ পরিপন্থী নানা রকম বক্তব্য রাখছেন। যেহেতু ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, সেজন্য তার এসব বক্তব্য সরকারের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর। এজন্য তারা মনে করে ড. ইউনূসের সঙ্গে একটি সমঝোতা হওয়া দরকার। এই সমঝোতার অগ্রগতির জন্য একটি বড় বিষয় হলো গ্রামীণ ব্যাংক। ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান উপদেষ্টা বা অন্য কোন সম্মানীয় পদ বসিয়ে একটি আপোষ-রফার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবী ছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে অর্থনীতিতে ডিগ্রি নেয়া এই অর্থনীতিবিদের মা ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের আমলে সংরক্ষিত আসনের এমপি ছিলেন। ড. দেবপ্রিয়র বাবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একজন আইনজীবী হিসেবে সুপ্রিম কোর্টে পরিচিত ছিলেন। সরকারের বিভিন্ন অর্থনৈতিক নীতি এবং কৌশলের তীব্র সমালোচক ড. দেবপ্রিয়। তিনি বিভিন্ন গবেষণার প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগের রাষ্ট্র পরিচালনার অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। তার সঙ্গেও আওয়ামী লীগ একটি সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। আওয়ামী লীগের একটি সূত্র বলছে, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান ইতিমধ্যে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন। সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় সেটা নিয়ে আলাপ হচ্ছে। সরকারের কট্টর সমালোচকদের মধ্যে একটি হলো ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাতদেশ (টিআইবি)। টিআইবির সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন রিপোর্টে সরকারের বিভিন্ন দুর্নীতির কথা বলেছে। নির্বাচন নিয়েও তারা একটি নেতিবাচক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। আওয়ামী লীগের একটি সূত্র বলছে, টিআইবির সঙ্গে বিরোধে না জড়িয়ে তাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য সরকার আগ্রহী হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন ইতিমধ্যে টিআইবির সঙ্গে কিছু কাজ শুরু করেছে। টিআইবির চেয়ারম্যান ড. সুলতানা কামালের সঙ্গে সমঝোতার জন্য ড. গওহর রিজভীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সুলতানা কামাল ঐতিহাসিকভাবেই আওয়ামী ঘরানার একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত। তার মা বেগম সুফিয়া কামাল আওয়ামী লীগের কঠিন সময়ের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রেও তার বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। কাজেই টিআইবি ও সুলতানা কামালের সঙ্গেও আওয়ামী লীগ একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতে চায়। এছাড়াও প্রভাবশালী কিছু মিডিয়া হাউজের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্কের টানাপোড়েন যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নেও আওয়ামী লীগ পদক্ষেপ নেবে বলে জানা গেছে। গণমাধ্যমে যারা সরকারের সমালোচক, সরকারের নেতিবাচক বিষয়গুলো যারা বেশি প্রচার করে থাকে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি ও আলাপ আলোচনার জন্য ড. গওহর রিজভীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় মিত্র ছিল দেশের সুশীল সমাজ ও বু্দ্ধিজীবীরা। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ছিল এবং স্বাধীনতা বিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। সেই সুশীল বুদ্ধিজীবীরাই যখন আওয়ামী লীগের সমালোচক হয়েছে, তখন সেটা আওয়ামী লীগের জন্য ইতিবাচক নয় বলেই আওয়ামী লীগের একটি অংশ মনে করছে। টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে যখন ঐক্যমতের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করার কথা বলছে আওয়ামী লীগ, তখন আওয়ামী লীগ চাচ্ছে, এরকম যারা দূরে সরে গেছেন, নানা অভিমান করে সরকারের সমালোচনা করছেন তাদের কাছে নিয়ে এসে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন অভিযাত্রায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংযুক্ত করতে। এমএ/ ১০:২২/ ১৪ ফেব্রুয়ারি

from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://bit.ly/2Gv150u