ঢাকা, ০২ ফেব্রুয়ারি- সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধ নিষ্পত্তি হয় ২০১২ সালে। এর ঠিক এক বছর পরই গভীর সমুদ্র থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু করে মিয়ানমার। বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানা ঘেঁষে অবস্থিত মিয়া ও শোয়ে কূপ থেকে এরই মধ্যে কয়েক ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করেছে দেশটি। তবে অর্ধযুগ পার হলেও এখনো নিজেদের অংশে জ্বালানি সম্পদের পরিমাণ নিরূপণে জরিপই শেষ করতে পারেনি বাংলাদেশ। ২০০৮ সালে অফশোর বিডিং রাউন্ডে বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলকে পানির গভীরতা অনুযায়ী দুই অংশে উপস্থাপন করা হয়। অগভীর সমুদ্র অঞ্চলকে ১১টি ব্লকে ও গভীর এলাকাকে ১৫টি ব্লকে ভাগ করা হয়। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তির পর ২০১২ সালের ডিসেম্বরে কয়েকটি ব্লকের সীমানা নতুন করে নির্ধারিত হয়। গভীর সমুদ্রের ১৫টি ব্লকের মধ্যে এ পর্যন্ত মাত্র একটিতে জরিপের কাজ শুরু হয়েছে। ডিএস-১২ ব্লকটিতে দ্বিমাত্রিক জরিপ শেষে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের কাজ করছে দক্ষিণ কোরীয় কোম্পানি পসকো দাইয়ু। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের পর ত্রিমাত্রিক জরিপের কাজ শুরু করবে প্রতিষ্ঠানটি। গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজে বাংলাদেশের অগ্রগতি বলতে শুধু এটুকুই। অথচ এ ব্লকটির পাশ ঘেঁষে মিয়ানমারের মিয়া ও শোয়ে গ্যাসকূপ থেকে ২০১৩ সালে গ্যাস উত্তোলন শুরু করে পসকো দাইয়ু। এরই মধ্যে সেখান থেকে উত্তোলনকৃত গ্যাস মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ ও চীনে রফতানি শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে বিরোধ মেটার আগেই সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করে মিয়ানমার। আর বিরোধ নিষ্পত্তির পর দেশটি দ্রুতই নিজেদের অংশে কূপ খনন ও উত্তোলন শুরু করে। অথচ সমুদ্রসীমায় নিরঙ্কুশ এখতিয়ার প্রতিষ্ঠার ছয় বছর পরও গভীর ও অগভীর সমুদ্রের মোট ২৬টি ব্লকের একটিতেও পূর্ণাঙ্গ জরিপ শেষ করতে পারেনি বাংলাদেশ। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালে ডিএস-১২ ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে পেট্রোবাংলা। এতে যৌথভাবে দর প্রস্তাব জমা দেয় কনোকোফিলিপস ও স্টাট অয়েল। পরবর্তী সময়ে কনোকোফিলিপস এ ব্লকে কাজ করতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে সরকারকে তা জানিয়ে দেয়। এ প্রক্রিয়ায় ব্লকটিতে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজটি থেমে থাকে প্রায় দুই বছর। ২০১৭ সালে ব্লকটিতে জরিপ, খনন ও উত্তোলনে দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি পসকো দাইয়ুর সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ। পাঁচ বছর মেয়াদি চুক্তিতে প্রথম দুই বছরে ১ হাজার ৮০০ লাইন কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক জরিপ, তৃতীয় বছরে ১ হাজার বর্গকিলোমিটার ত্রিমাত্রিক জরিপ এবং চতুর্থ ও পঞ্চম বছরে একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করার শর্ত দেয়া হয়। যদিও বাংলাদেশের জলসীমা ঘেঁষেই একের পর এক নতুন কূপ আবিষ্কার ও সেগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলন করতে থাকে মিয়ানমার। জানা গেছে, আগামী মার্চে দ্বিমাত্রিক জরিপের সময় শেষ হতে চললেও এখনো ওই জরিপের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ শেষ করেনি পসকো দাইয়ু। এজন্য আরো নয় মাস সময় পাচ্ছে কোরীয় প্রতিষ্ঠানটি। সেই সঙ্গে তারা অনুসন্ধানকাজের জন্য অংশীদার খুঁজছে। পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক (পিএসসি) শাহনেওয়াজ পারভেজ এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রথম দুই বছরে তাদের ১ হাজার ৮০০ লাইন কিলোমিটার জরিপ করার কথা ছিল। তারা প্রায় ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটার লাইন জরিপ করেছে। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং দ্বিমাত্রিক জরিপের ডাটা ইন্টারপ্রিটেশনের সুবিধার্থে সময় আরো নয় মাস বাড়ানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে ত্রিমাত্রিক জরিপের সময়ও তিন মাস বাড়িয়ে এক বছর তিন মাস করা হয়েছে। আর অনুসন্ধান কূপ খননের সময় দুই বছর থেকে কমিয়ে করা হয়েছে এক বছর। প্রাথমিকভাবে দাইয়ু ভালো সম্ভাবনা দেখছে। ত্রিমাত্রিক জরিপ শেষে এ বিষয়ে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যাবে। জ্বালানি সম্পদ অনুসন্ধানে বাংলাদেশের অগ্রগতি যখন জরিপেই আটকে আছে, তখন মিয়ানমার তাদের ব্লকগুলো থেকে প্রথম পর্যায়ের গ্যাস আহরণ শেষে গ্যাসক্ষেত্রগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের উন্নয়নের কাজ হাতে নিয়েছে। এরই মধ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ পসকো দাইয়ু বাংলাদেশের সীমানার কাছে দ্বিতীয় পর্যায়ের কূপ খননের জন্য গভীর সমুদ্রে জ্বালানি অবকাঠামো নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ম্যাকডরমেটের সঙ্গে গত বছরের জুনে চুক্তি করেছে। ২০২১ সালের মধ্যে এ পর্যায় থেকেও গ্যাস উত্তোলনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। জ্বালানি খাতের কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষার কারণেই সমুদ্র সম্পদ আহরণে এ ধীরগতি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা, যে কারণে স্থলভাগ ও সমুদ্রসীমায় অনুসন্ধান কার্যক্রম গতিশীল না করে ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও ভূতত্ত্ববিদ ড. বদরুল ইমাম বলেন, শুধু দেরি নয়, আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি। ২০১২ সালের পর মিয়ানমার তাদের অংশে অনুসন্ধান কার্যক্রম কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। এর ফলও পেয়েছে তারা। এরই মধ্যে উত্তোলন শুরু হয়েছে তাদের ক্ষেত্রগুলো থেকে। সমুদ্রসীমা জয়ের ছয় বছর পেরিয়ে গেছে। এ সময়ে আমরা একটি কূপ খনন তো দূরের কথা, জরিপ কার্যক্রমই শেষ করতে পারিনি। এটা অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। সূত্র জানায়, গভীর সমুদ্রের পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরের অগভীর অংশের ১১ নং ব্লক সান্তোস ও ক্রিস এনার্জি এবং ৪ ও ৯ নম্বর ব্লক ভারতীয় দুই কোম্পানি ওএনজিসি বিদেশ লিমিটেড (ওভিএল) ও অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেডকে (ওআইএল) বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এসএস-১১ ব্লকে দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক জরিপ করেছে সান্তোস। কিন্তু আশানুরূপ কোনো ফলাফল এখনো জানা যায়নি। তবে চলতি বছরের প্রথমার্ধে কোম্পানিটি একটি কূপ খনন করবে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে এসএস-৪ ও এসএস-৯ নম্বর কূপে মাত্র দ্বিমাত্রিক জরিপ শেষ হয়েছে। সূত্র: বণিক বার্তা এইচ/১৪:১৩/০২ ফেব্রুয়ারি

from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://bit.ly/2UAdVNY